যোহরের নামাজ কয় রাকাত: বিস্তারিত নির্দেশিকা

তুমি যদি নামাজ পড়ো বা ইসলামি জীবনাচারে আগ্রহী হও, তাহলে যোহরের নামাজ সম্পর্কে জানতে হবে। প্রতিদিনের পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের মধ্যে যোহর একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নামাজ। এটি দিনের মধ্যভাগে পড়া হয় — যখন সূর্য ঠিক মাথার ওপরে থেকে হেলে পড়তে শুরু করে। এই সময়টা বেশ ব্যস্ততার, কিন্তু ঠিক তখনই আল্লাহর কাছে দাঁড়িয়ে যাওয়াটাই এক প্রকৃত মুমিনের পরিচয়।
যোহরের নামাজ শুধু একটা ফরজ ইবাদত নয়, বরং এটি আত্মা প্রশান্ত করার, কর্মব্যস্ততা থেকে একধরনের বিরতি নেওয়ার এবং আল্লাহর সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করার এক বিশেষ সময়। অনেকেই প্রশ্ন করেন যোহরের নামাজ কয় রাকাত, কিন্তু জানার পর দেখা যায়, শুধু ফরজ নয়, এর আগে ও পরে সুন্নত রাকাতগুলোও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এই নামাজ রাসূল (সা.) ও সাহাবায়ে কেরামের জীবনে ছিল নিয়মিত এবং গুরুত্বপূর্ন একটি আমল। দিনে একবার হলেও এই নামাজটা আমাদের ব্যস্ত জীবনে থেমে যাওয়ার সুযোগ দেয়—নিজের কর্ম, চিন্তা ও আত্মাকে একসঙ্গে আল্লাহর সামনে উপস্থাপন করার জন্য।
এই প্রবন্ধে আমি তোমাকে জানাবো যোহরের নামাজের মোট রাকাত, এর সময়সূচি, সুন্নত ও ফরজ রাকাতের বিস্তারিত, এবং প্রয়োজনীয় নিয়ত ও পদ্ধতি। তাহলে তুমি শুধু জানবে না—বরং সঠিকভাবে আদায়ও করতে পারবে।
যোহরের নামাজের রাকাত সংখ্যা
তুমি যদি জানতে চাও যোহরের নামাজ কয় রাকাত, তাহলে উত্তরটি সরল হলেও এর পেছনের দিকটি একটু বিস্তারিত। যোহরের নামাজ মোট ১২ রাকাত—যার মধ্যে ফরজ, সুন্নত ও নফল সবই অন্তর্ভুক্ত।
১. ৪ রাকাত সুন্নতে মুয়াক্কাদা (নামাজের পূর্বে)
নামাজের আগে ৪ রাকাত সুন্নত পড়া রাসূল (সা.)-এর নিয়মিত আমলের অংশ। এটিকে সুন্নতে মুয়াক্কাদা বলা হয়, অর্থাৎ এই সুন্নত না পড়া গোনাহ না হলেও তা অবহেলা করা উচিত নয়। সাহাবিদের জীবনে এই ৪ রাকাত ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই নামাজে ধীর স্থিরভাবে কিরাত পড়া, রুকু-সিজদাহ সম্পূর্ণভাবে আদায় করা উত্তম।
২. ৪ রাকাত ফরজ (অবশ্যই আদায়যোগ্য)
এরপর আদায় করা হয় ৪ রাকাত ফরজ, যা ইসলামে বাধ্যতামূলক। এটি এমন একটি ইবাদত যা ইচ্ছাকৃতভাবে ফেলে দিলে তা মারাত্মক গোনাহ। ফরজ নামাজ পড়তে গিয়ে জামাআতের গুরুত্ব অনেক বেশি। ঘরে একা পড়া গেলেও মসজিদে জামাআতে পড়ার ফজিলত অনেক গুণ বেশি।
৩. ২ রাকাত সুন্নতে মুয়াক্কাদা (নামাজের পরে)
ফরজ নামাজের পরে আরও ২ রাকাত সুন্নত পড়া হয়। এটিও রাসূল (সা.)-এর জীবনের অংশ এবং নিয়মিত চর্চা। এই সুন্নত আদায় করলে আল্লাহর কাছে নেকি বৃদ্ধি পায় এবং এটা ঈমানদার ব্যক্তির সৌন্দর্যের প্রকাশ।
৪. অতিরিক্ত ২ রাকাত নফল (ঐচ্ছিক)
ইচ্ছা করলে তুমি আরও ২ রাকাত নফল নামাজ পড়তে পারো। যদিও এটি আবশ্যক নয়, তবে এর মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করা যায়। নফল ইবাদত ব্যক্তি ও আল্লাহর মধ্যে সম্পর্ক আরও গভীর করে।
এখন তুমি যদি কাউকে প্রশ্ন করো যোহরের নামাজ কয় রাকাত, তাহলে বলবে—৪ রাকাত সুন্নত, ৪ রাকাত ফরজ, ২ রাকাত সুন্নত ও ২ রাকাত নফল—মোট ১২ রাকাত। তবে ফরজ ও পূর্বের সুন্নতকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়।
যোহরের নামাজের সময়সূচি
তুমি যদি যোহরের নামাজ সময়মতো আদায় করতে চাও, তাহলে এর নির্ধারিত সময় সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা থাকা অত্যন্ত জরুরি। ইসলাম আমাদের এমন একটি সময়সূচি দিয়েছে, যার মাধ্যমে প্রতিটি নামাজ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পড়া হয়। যোহরের নামাজও এর ব্যতিক্রম নয়।
যোহরের ওয়াক্ত শুরু ও শেষ
যোহরের নামাজ শুরু হয় তখন, যখন সূর্য মধ্যাকাশ থেকে হেলে পড়ে — অর্থাৎ, যেদিন সূর্য সোজা মাথার ওপর থাকে, সেটার পরপরই যোহরের ওয়াক্ত শুরু হয়। এই সময়টিকে বলা হয় “জওয়ালুশ শামস”। সূর্য যখন পশ্চিম দিকে ঢলে পড়ে এবং প্রতিটি বস্তুর ছায়া তার আসল দৈর্ঘ্যের সমান হয়ে যায়, তখন যোহরের সময় শেষ হয়ে যায় এবং আসরের ওয়াক্ত শুরু হয়।
একটি সহজ হিসাব অনুযায়ী, যোহরের নামাজ সাধারণত দুপুর ১২:১৫ থেকে শুরু হয়ে প্রায় ৩টা পর্যন্ত থাকে, তবে স্থান ও ঋতুভেদে সময় পরিবর্তিত হয়। তাই স্থানীয় ইসলামি সময়সূচি অনুসরণ করাই উত্তম।
সময় নির্ধারণের ইসলামী পদ্ধতি
প্রাচীনকালে সাহাবাগণ সূর্যের অবস্থানের মাধ্যমে সময় নির্ধারণ করতেন। বর্তমানে যদিও মোবাইল অ্যাপস বা ওয়েবসাইট ব্যবহার করে সময় জানা যায়, তবুও সূর্যের ছায়া পর্যবেক্ষণ একটি সুন্নত পদ্ধতি হিসেবেও বিবেচিত।
তুমি যদি জানতে চাও যোহরের নামাজ কয় রাকাত এবং কখন পড়া হয়, তাহলে সময় ও রাকাত—দুটোর সঠিক জ্ঞান থাকা দরকার। কারণ, নির্দিষ্ট সময়ের বাইরে নামাজ পড়া গ্রহণযোগ্য নয়।
যোহরের নামাজের নিয়ত ও পদ্ধতি
তুমি যদি নামাজ আদায়ে মনোযোগী হতে চাও, তাহলে নিয়ত বা নিয়তিই হলো প্রথম ধাপ। নিয়ত মানে হলো — নামাজের উদ্দেশ্য অন্তরে স্থির করা, যা মুখেও উচ্চারণ করা যায়। যোহরের নামাজ পড়ার আগে নিয়ত করা ফরজ অংশ না হলেও, এটি সুন্নাত এবং নামাজে মনোযোগের জন্য সহায়ক।
যোহরের ফরজ নামাজের নিয়ত
আরবি উচ্চারণ:
نَوَيْتُ أَنْ أُصَلِّيَ أَرْبَعَ رَكَعَاتٍ فَرْضَ الظُّهْرِ لِلَّهِ تَعَالَى مُتَوَجِّهًا إِلَى جِهَةِ الْكَعْبَةِ
বাংলা উচ্চারণ:
“নাওয়াইতু আন উসাল্লিয়া আরবা’ রাকা’আতিন ফারদায যুহরি লিল্লাহি তা’আলা, মুতাওয়াজ্জিহান ইলা জিহাতিল কা’বাহ।”
বাংলা অর্থ:
“আমি নিয়ত করলাম, চার রাকাত যোহরের ফরজ নামাজ আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে কাবার দিকে মুখ করে আদায় করবো।”
তুমি চাইলে একইভাবে সুন্নত নামাজেরও নিয়ত করতে পারো, শুধু “ফারদায যুহরি” এর জায়গায় “সুন্নাতায যুহরি” বলবে।
নামাজ আদায়ের পদ্ধতি (সংক্ষেপে)
১. তাকবিরে তাহরিমা দিয়ে শুরু করো — “আল্লাহু আকবার” বলে হাত বেঁধে দাঁড়াও।
2. সূরা ফাতিহা পড়ো, এরপর অন্য একটি সূরা বা কুরআনের আয়াত।
3. রুকুতে যাও, তারপর সিজদাহ, এরপর কিয়াম।
4. প্রত্যেক রাকাতে একই পদ্ধতি অনুসরণ করো।
5. ২য় এবং ৪র্থ রাকাতে তাশাহহুদ পড়ো।
6. শেষ রাকাতে দরুদ শরীফ ও দোয়া মাসুরা পড়ে সালাম ফেরাও।
যোহরের ৪ রাকাত ফরজ নামাজের প্রথম ২ রাকাতে কিরাত পড়া হয় জোরে নয়, বরং নিঃশব্দে। এবং এই নিয়ম সুন্নত ও নফল নামাজের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী
১. যোহরের নামাজ কয় রাকাত?
এই প্রশ্নের উত্তর বেশ পরিষ্কার: যোহরের নামাজ মোট ১২ রাকাত। এর মধ্যে রয়েছে:
- ৪ রাকাত সুন্নতে মুয়াক্কাদা (নামাজের আগে)
- ৪ রাকাত ফরজ (অবশ্যই আদায়যোগ্য)
- ২ রাকাত সুন্নতে মুয়াক্কাদা (নামাজের পরে)
- ২ রাকাত নফল (ঐচ্ছিক, কিন্তু ফজিলতপূর্ণ)
এই রাকাত সংখ্যা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নিয়মিত চর্চা এবং সাহাবিদের দ্বারা অনুসৃত হয়েছে। তাই কেউ যদি জানতে চায় যোহরের নামাজ কয় রাকাত, তাকে এই পূর্ণ কাঠামো জানানো উচিত।
২. যদি কেউ যোহরের পূর্বের ৪ রাকাত সুন্নত পড়তে না পারে, তবে তার করণীয় কী?
যদি কোনো কারণবশত তুমি পূর্বের ৪ রাকাত সুন্নত পড়তে না পারো, তবে তা পরে কাযা করা সুন্নতের মর্যাদা বহন করবে না। তবে নিয়মিতভাবে তা ফেলে দেওয়া গোনাহর আশঙ্কা তৈরি করতে পারে। তাই তুমি চেষ্টা করো যেন এই ৪ রাকাত সুন্নত নিয়মিত আদায় করতে পারো। এটা রাসূল (সা.)-এর প্রিয় সুন্নতের মধ্যে একটি।
৩. যোহরের নামাজের সময় কখন শুরু হয় এবং কখন শেষ হয়?
যোহরের নামাজ শুরু হয় সূর্য যখন মাথার ওপরে থেকে হেলে পড়ে, এবং শেষ হয় যখন প্রতিটি বস্তুর ছায়া তার সমান অথবা দ্বিগুণ হয়, অর্থাৎ আসরের সময় শুরু হওয়ার আগে পর্যন্ত। সময় নির্ধারণের জন্য স্থানীয় নামাজের সময়সূচি অনুসরণ করাই উত্তম।
৪. মুসাফির অবস্থায় যোহরের নামাজের রাকাত সংখ্যা কীভাবে আদায় করতে হবে?
তুমি যদি মুসাফির হও (৮৮ কিমি বা তার বেশি দূরত্বে ভ্রমণরত), তাহলে ফরজ নামাজ ২ রাকাতে সংক্ষেপ করা হয়। সুন্নত ও নফল নামাজ পড়া ঐচ্ছিক থাকে, কিন্তু ফরজ ৪ এর পরিবর্তে ২ রাকাত পড়াই ইসলামী শরিয়ত অনুযায়ী সঠিক।
উপসংহার
যোহরের নামাজ শুধু একটি রুটিন ইবাদত নয়—বরং এটি এমন এক সময়ের ইবাদত, যখন তুমি কর্মব্যস্ত দিনের মাঝখানে আল্লাহর কাছে ফিরে যাও। এই নামাজ আত্মা শান্ত রাখে, অন্তরকে পরিশুদ্ধ করে এবং তোমার কর্মে বরকত আনে। তাই প্রতিদিনের পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের মধ্যে যোহর একটি ভারসাম্য রক্ষাকারী নামাজ হিসেবেও দেখা যায়।
এখন তুমি পরিষ্কারভাবে জানো যোহরের নামাজ কয় রাকাত এবং তার প্রতিটি রাকাতের পেছনে কী তাৎপর্য আছে। ৪ রাকাত সুন্নতে মুয়াক্কাদা, ৪ রাকাত ফরজ, ২ রাকাত সুন্নত এবং ২ রাকাত নফল—এই পুরো কাঠামোই যোহরের নামাজকে পূর্ণতা দেয়। যদিও ফরজ রাকাত আদায় করাটাই বাধ্যতামূলক, তবুও সুন্নত ও নফল রাকাতগুলোর গুরুত্ব উপেক্ষা করার মতো নয়।
আমরা অনেক সময় ব্যস্ততার অজুহাতে যোহরের নামাজ সময়মতো পড়ি না বা তা সংক্ষিপ্ত করে ফেলি। কিন্তু মনে রেখো, এই নামাজ রাসূল (সা.) এবং সাহাবিদের জীবনে ছিল নিয়মিত ও প্রিয় আমল। এটি শুধু ইবাদত নয়, বরং এক মানসিক প্রশান্তির উৎস।
তুমি যদি প্রতিদিন এই নামাজ যথাযথভাবে আদায় করো, তাহলে দেখবে জীবনের অন্য সমস্যাগুলোতেও ধৈর্য, সংযম ও আত্মবিশ্বাস বাড়বে। সময় মতো পড়া, সঠিক নিয়ত করা এবং মনোযোগ সহকারে প্রতিটি রাকাত আদায় করা—এই হল মূল চাবিকাঠি।